ঐতিহ্য ফিরে পাচ্ছে পুরান ঢাকার লালকুঠি। ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনা ঘিরে তৈরি হওয়া অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে মূল ভবনটি সংস্কার করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। আদি রূপ ফিরিয়ে আনতে কুঠির সামনের লঞ্চ টার্মিনালটি সরিয়ে নিতে বিআইডব্লিওটিএ’কে এরিমধ্যে অনুরোধ জানিয়েছে নগর প্রশাসন। আর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন, ঐতিহ্যের নগরী গড়তে ঐতিহ্য সংরক্ষণ জরুরি। কারণে, এরিমধ্যে অনেক ঐতিহ্য দখল হয়ে গেছে। লালকুঠির সেই জৌলুস আর নেই। লাল রংও এখন। জায়গায় জায়গায় খসে পড়েছে পলেস্তরা। অথচ একটি সময় ঢাকা শহরের বিনোদন ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিলো এটি। ১৮৭৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যারিং নর্থব্রুকের ঢাকা সফর উপলক্ষে টাউন হল হিসেবে এই ভবনটি নির্মাণ করা হয়। নামকরণ করা নর্থব্রুক হল। বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে ফরাশগঞ্জের দালানটি লাল রঙের হওয়ায় সেটি স্থানীয়দের কাছে পরিচিতি পায় লালকুঠি হিসাবে। সেই তখন থেকেই এটি লালকুঠি নামেই বেশি পরিচিত। ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এই লালকুঠিতেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। ২০ শতকের ষাটের দশকের প্রতি সপ্তাহেই নাটক চলছে। সেসব এখন অতীত। বহুদিন তালাবদ্ধ লালকুঠি এখন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। চারপাশ ঘিরে ঘাট, ব্যবসা কেন্দ্র, দোকানপাট, সেসব জঞ্জাল সরিয়ে লালকুঠিকে পুরনো রূপে ফিরিয়ে আনতে চায় দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। সোমবার লালকুঠিতে অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি নেইবারহুড আপগ্রেডিং প্রজেক্টের প্রদর্শনীতে মেয়র ফজলে নূর তাপস সেই কথাই জানালেন। তিনি জানান, পুরান ঢাকার লালকুঠির সামনে থেকে দ্রুত লঞ্চঘাট সরানোর জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডাব্লিউটিএ) নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। শেখ তাপস বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী ঘেঁষে গড়ে ওঠেছে আমাদের ঢাকা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা এই ঐতিহাসিক স্থাপনা থেকে এখন আর বুড়িগঙ্গা দেখতে পাই না। কারণ, সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি দখলদারিত্বের ছোবলে নদী আজ দখল হয়ে গেছে। তাই, আমি বিআইডব্লিউটিএ-কে অনুরোধ করবো, দ্রুত লালকুঠি হতে রূপলাল হাউজ পর্যন্ত অংশে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল সরিয়ে ফেলুন। ঢাকার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও ফিরিয়ে আনতে এটাই সর্বোত্তম সময় উল্লেখ করে মেয়র বলেন, ঢাকার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর দুঃখজনকভাবে দেখলাম, লালকুঠি আর ঢাকা গেটই শুধু করপোরেশনের আওতাধীন। রূপলাল হাউজসহ যেসব স্থাপনা ঢাকার অস্তিত্ব সৃষ্টি করেছে, ঢাকাকে পরিচিতি দিয়েছে— সেগুলো করপোরেশনের আওতাধীন নয়। তাই রূপলাল হাউজ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় হস্তান্তর করতে আজকের অনুষ্ঠানে প্যানেলিস্টদের যে দাবি, সেই দাবির সঙ্গে আমিও একাত্মতা পোষণ করছি। রূপলাল হাউজ আমাদেরকে হস্তান্তর করলে আমরা এর পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করবো। আমরা ঢাকার সব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও স্মৃতিস্তম্ভের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে চাই। আলোচনায় অংশ নিয়ে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, রূপলাল হাউজ অবৈধ দখলের কবলে রয়েছে। আমি মেয়রকে বলবো, এটাকে দখলমুক্ত করুন। আপনারা যারা এখানে উপস্থিত আছেন, আমি বলবো, আপনারা মানে ঢাকাবাসী চাইলে রূপলাল হাউজকে দখলদার মুক্ত করা সম্ভব। আমি মেয়রকে অনুরোধ করবো- যে অবৈধ স্থাপনা হয়েছে, তা ভেঙে ফেলুন। এসব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সিটির আওতায় নিয়ে আসুন। তাহলেই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। ঐতিহাসিক স্থাপনা ধরে রাখার গুরুত্ব তুলে ধরে বাংলাদেশে স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, কেউ চাইলেই ঐতিহাসিক স্থাপনা ভেঙে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা যায়, সাময়িকভাবে হয়তো লাভবানও হওয়া যায়।এতে ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা যায় না। কিন্তু ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে আমার শহরে নিয়ে আসতে পারা যেমন মর্যাদার, তেমনই পর্যটক আকর্ষণে লাভবান হওয়াটা সম্মানেরও। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়া সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এর রিজিওনাল ডাইরেক্টর জন রুম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ফজলে রেজা সুমন, দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বক্তব্য রাখেন।
হারান জৌলুস ফিরে পাচ্ছে পুরনো ঢাকার লালকুঠি
প্রকাশ : May 24, 20224:08 am
